ঘটনাপ্রবাহ
জুলাই বিপ্লবে নারী
শাহীন আখতার আঁখি
জুলাই বিপ্লবে নারীরা বা আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, ছাত্রীরা ছিল ভ্যানগার্ড। নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই বিপ্লব সফল হতো না।
যে ১১ জন নারী শাহাদতবরণ করেছেন, অসংখ্য আহত হয়েছেন, আর যারা নীরবে ঘরে ফিরে গেছেন, তাদের সবার গল্পগুলো সামনে নিলে আমরা এ বিষয়ে একটা স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারি।
২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে যুক্ত ছিল অনেক ছাত্রী। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি, ২০২৪ এর জুলাইয়ের শুরু থেকেই ছাত্রীরা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে।
১৪ই জুলাই শেখ হাসিনা যখন অত্যন্ত অন্যায্য, অসংগত ও অযৌক্তিকভাবে শিক্ষার্থীদের অপমানসূচক রাজাকারের নাতিপুতি আখ্যা দেয়, সেদিন রাতেই ছাত্রদের পাশাপাশি হলের তালা ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা অসীম সাহস বুকে নিয়ে 'আমি কে তুমি কে/রাজাকার রাজাকার' স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই স্লোগানে সরকারের নৈতিক পরাজয় ঘটে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়- এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল হয়। মধ্যরাতের সে বিক্ষোভ অনুরণিত হয় সারা বাংলাদেশের হৃদয়ে।
ফ্যাসিবাদের অত্যাচারে জর্জরিত, একটি পরিবর্তনের অপেক্ষায় উন্মুখ জনগণ দেখল অনাগত বিপ্লবের মহাগর্জন, বাঁধ ভাঙা ঢেউ। সেদিন সেই মিছিলেই যেন রচিত হয়ে গিয়েছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের ঘোষণাপত্র।
১৫ই জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরের দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ফ্যাসিবাদের লাঠিয়াল ছাত্রলীগ বাহিরাগত ভাড়া করা টোকাই ও গুন্ডাদের নিয়ে ভয়ংকর আক্রমণ চালাল শিক্ষার্থীদের উপর। বিশেষ করে ছাত্রীদের উপর তারা বর্বোরচিত হামলা চালায়। বহু সংখ্যক ছাত্রীর রক্ত ঝরে। এ হামলায় মোট আহত ছিল প্রায় তিনশত শিক্ষার্থী। আহতরা চিকিৎসা নিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সেখানেও তাদের ওপর হামলা করা হয়।
প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। দিনের পর দিন ছাত্রলীগের হাতে নিগৃহীত ছাত্রদের কন্ঠে স্লোগান ওঠে, 'টোকাইদের ঠিকানা/এই ক্যাম্পাসে হবে না; সন্ত্রাসীদের ঠিকানা/এই ক্যাম্পাসে হবে না।'
হাসপাতালে ঢুকে আহতদের হামলায় প্রমাণিত হয়, একটি রাজনৈতিক দল সুনাগরিক বা কর্মী তৈরি না করে কিছু নরপিচাশ তৈরি করেছিল।
বোনদের লাঞ্ছনায় সারাদেশে জেগে উঠল ভাইবোনেরা। প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করে রংপুরের রাজপথে শাহাদতবরণ করেন আবু সাঈদ। অন্যায়ের প্রতিবাদে আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সেই মহাকাব্যিক আত্মত্যাগের দৃশ্য সে সময় সবার আত্মাকে স্পর্শ করে। তার মহান আত্মত্যাগে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোও গুরুত্ব দিয়ে সে সংবাদ প্রচার করে। আবু সাঈদের বোনের কান্না-আহাজারি যেন সারা বাংলাদেশের কান্না-আহাজারিতে পরিণত হয়। এ কান্নার দ্রোহ শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে নাড়িয়ে দেয়।
সারাদেশে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভাইদের নিরাপত্তার জন্য বোনেরা অবস্থান নিয়েছে মিছিলের সম্মুখসারিতে নিরাপত্তাপ্রাচীর হয়ে। শুরু হয় টানা আন্দোলন এবং বাংলা ব্লকেড নাম নিয়ে আবরোধের মতো কর্মসূচি।
১৭ই জুলাই, বুধবার; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করা হয়। এ কাজে প্রথম এগিয়ে আসে রোকেয়া হলের আমাদের সাহসী বীর ছাত্রীরা। পরে অন্যান্য হলে তা ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর ৯ দফা দেওয়া হয় এবং রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল। ইন্টারনেট বন্ধ থাকে প্রায় ১০ দিন। আন্দোলন দমাতে সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে সংগ্রাম অব্যাহত রাখে ছাত্র সমন্বয়ক পরিষদ ও সমমনা ছাত্র সংগঠনগুলো। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।
বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাট ডাউন, রিমেম্বারিং হিরোজ, মার্চ ফর জাস্টিস, দ্রোহ যাত্রা- প্রতিটি কর্মসূচিতে ছাত্রীরা-নারীরা অংশগ্রহণ করে ব্যাপক হারে।
লাখো গ্রাফিতিতে ছেয়ে যায় রাজধানীর রাজপথ থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের অলিগলি পর্যন্ত। গ্রাফিতি অংকনেও ছাত্রীদের অধিকতর সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখেছি আমরা।
এ সময় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কিছু উক্তি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। 'পেছনে পুলিশ সামনে স্বাধীনতা' -সানজিদা চৌধুরী; 'আমার ছাত্রের মুখ চেপে ধরেননি, বাংলাদেশের মুখ চেপে ধরেছেন' -ডক্টর চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস।
১লা আগস্ট খুনি হাসিনার ছবি নিজের অফিস থেকে নামিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা বলেন, যার হাতে আমার সন্তানের রক্ত লেগে আছে, তার ছবি দেওয়ালে রাখতে চাই না। 'দেশটা কারে বাপের না।' একজন ছাত্রী তার দুটো খালি হাত দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল পুলিশের দানব ট্রাক থামাতে।
জেগে উঠেছিল একক জাতিসত্তার এক অভূতপূর্ব বাংলাদেশ।
ছোট্ট শিশুকিশোররা এক-একজন মীর মুগ্ধ হয়ে রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল পানি হাতে। গুলির ভয়ে রাস্তায় নামতে না পারলেও ঘরের জানালা দিয়ে শিশুরা ছুড়েছিল পানির বোতল, প্রতিরোধের জন্য ইটের টুকরা, লাঠি।
মায়েরা খাবার নিয়ে হাজির হলেন রাজপথে। পেয়ারা বিক্রেতা বিলিয়ে দিলো তার ভ্যানের সব পেয়ারা। পুলিশ ও ছাত্রলীগের আক্রমণের মুখে রাস্তায় অজানা-অচেনা তরুণ-তরুণীদের আশ্রয়-খাবার দিয়ে আগলে রেখেছেন বহু গৃহবাসী। সারা বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল রণক্ষেত্র। বিশেষ করে ঢাকায় চারদিকে কেবল ছিল গুলির শব্দ। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে খুনি হাসিনা হেলিকপ্টারে করে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর মারণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়, সাথে ছিল স্নাইপার।
ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে নারকীয় তাণ্ডব ও নৈরাজ্য চালায় আওয়ামী দুর্বৃত্তরা। সব হামলা আক্রমণের সামনে কিংবা পেছনে আমাদের মায়েরা-বোনেরা-ছাত্রীরা সাহসের বাতিঘর হয়ে অনড়-অটল ছিল। ভাইয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে দুই বোনকে আমরা দেখেছি স্লোগানে বিদীর্ণ করেছে রাজপথ। এমনই লাখো ইতিহাস রচিত হয়েছে জুলাই বিপ্লবের রাজপথে।
বিশেষ করে ছাত্রীদের আগ্রণী ভূমিকা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত হতো না। মুক্ত হতো না বাংলাদেশও। সারাদেশে অসীম সাহস নিয়ে লড়াই করেছে নারীরা। বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবে নারীদের এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ফ্যাসিবাদ উৎখাতের ইতিহাসে।
বিপ্লবোত্তর পরিবর্তিত সমাজিক ও পারিবারিক পরিস্থিতির একটা বড় দায় মূলত চেপেছে নারীর কাঁধে।
শহীদদের রেখে যাওয়া পরিবার, সন্তান এখন তার স্ত্রী কিংবা মায়ের জিম্মায়। আহত যোদ্ধার চিকিৎসায় স্ত্রীর গহনা বিক্রি করতে হয়েছে বলে আমরা পড়েছি খবরের কাগজে। আহতদের শুশ্রূষায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে পরিবার-পরিজন।
বিপ্লবোত্তর নারীর ভূমিকা নিয়ে আলাপ উঠেছে বিভিন্নভাবে। বিষয়টাকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। তার সরলীকরণ করা সম্ভব না একেবারেই।
যারা দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিয়ে মাঠে ছিলেন, তাদেরকে আমরা নিজ নিজ অবস্থানে সক্রিয় দেখতে পাচ্ছি। কেউবা আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এখনও কোথাও মনস্থির করে সক্রিয় হতে পারেননি।
যারা শুধুমাত্র স্বৈরাচার পতনের লক্ষ্য রেখে ময়দানে নেমেছিলেন, তারা স্বৈরাচার পতনে সন্তুষ্ট হয়ে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে গেছেন, বিপ্লবোত্তর সময়ে ও গুটিকয় জনের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে বিব্রত হয়ে অনেক মেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সামাজিক বা রাজনৈতিক সক্রিয়তা থেকে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ঘরকেই তার আসল কর্মক্ষেত্র মনে করে। এ মনস্তাত্ত্বিকতাও নারীদের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার কারণ। অন্যদিকে যেসব পরিবার এই আন্দোলনে তাদের পুরুষ সদস্যদের হারিয়েছে, সেসব পরিবারের নারী ও শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ক্ষেত্র বিশেষে আক্রান্তও হচ্ছে নানাভাবে। শহীদ ও আহত পরিবারগুলোর সামাজিক সুরক্ষার জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
তবে কোনোদিন যদি তারা আবার মনে করেন, দেশের প্রয়োজনে, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাকে এগিয়ে আসতে হবে, নিশ্চয়ই তখন নারীরা আবার দ্রোহের মশাল জ্বেলে এগিয়ে আসবে রাজপথে।
এই বিপ্লবে কোটি মানুষের অংশগ্রহণে কোটি গল্প রচিত হয়েছে। অনেক মানুষই যখন তার নিজের গল্পটা বলবে, তখন আমাদের জানা হবে বিপ্লবের বিস্তৃত ইতিহাস।
ফ্যাসিবাদ, মাফিয়াতন্ত্র আমাদের সামাজিক নৈতিকতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ধ্বংস করে গেছে, সেগুলোর পুনর্নির্মাণই এখন আমাদের সবার জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।