সমাজ পরিগঠনের নারীর ভূমিকা

নুরুন্নিসা সিদ্দিকা

কয়েকটি পরিবারের কাছাকাছি বসবাস, পারস্পরিক লেনদেন, ভাববিনিময় সমাজ নামে পরিচিত। সমাজের ইউনিট পরিবার আর পরিবারের ইউনিট ব্যক্তি। দুইয়ের কোন একটি ছাড়া পরিবার ও সমাজ অচল। আমাদের প্রশ্ন নারীদের ভূমিকা নিয়ে।

সমাজের ধ্বংসকারিতা

আমরা পত্র-পত্রিকায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রায়ই দেখতে পাই নারীঘটিত অনেক বিষয়। স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রী কে হ্যারাস করা, বিধবার জমি আত্মসাৎ, বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ, নারীর জন্য অনিরাপদ পথঘাট এমনকি নিজের গৃহকোণও। স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যার ঘটনা তো নিত্যনৈমিত্তিক। আবার পিছিয়ে নেই নারীরাও। নানা নিষ্ঠুর আচরণ। স্বামী হত্যা, কেটে টুকরা করা, পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা, এমনকি হত্যা করে শরীর জ্বালিয়ে দেওয়ার হৃদয়বিদারী ঘটনা আমাদের দেখতে হচ্ছে। মায়েরা তাদের সন্তানের প্রতি হয়ে উঠেছে নির্দয় নিষ্ঠুর। বিগত কয়েক বছরে মা কর্তৃক বেশকিছু সন্তান হত্যার ঘটনা ঘটেছে এককথায় সমাজের বিপদগামিতায় নারীরা কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, দেহব্যবসা, জাল টাকা তৈরি, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, চোরাচালান সবকিছুতেই নারীর আজ জড়িত। সমাজ বিধ্বংসী এ ধরনের নারী-পুরুষের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের ভাষ্য -

মুনাফিক পুরুষ ও মহিলা পরস্পর একই ভাবাপন্ন। তারা খারাপ কাজের প্ররোচনা দেয়, ভালো কাজ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজের বেলায় নিজেদের হাত গুটিয়ে রাখে। এরা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে এবং আল্লাহও তাদের ভুলে গিয়েছেন। এই মুনাফিকরাই পাপাচারী। [সূরা তাওবা: ৬৭]

উপরের ধ্বংসকারীতার বিবরণ দেখে আমাদের হতাশা এসে যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে এরা সমাজের ক্ষুদ্র অংশ। বৃহত্তর সমাজ ন্যায় ও কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করলেই দুষ্কৃতিকারীদের প্রভাব ও সংখ্যা কমে আসবে। আমরা পর্যায়ক্রমে তাই আলোচনা করব।

পরিবারের নারীদের ভূমিকা

মেয়ে হিসাবে একটি নারী যখন মাতৃক্রোড়ে বেড়ে ওঠে তখন তিন বছর বয়স থেকেই তার ব্যক্তিত্বের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। শিশুর আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত না দেয়া, ভালো ও মন্দের পার্থক্য শিখানো এবং ভালো কাজে তাকে উৎসাহিত করা দরকার। কোন কাজের বিভাজন তৈরি করে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত কাউকে ছোট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বাবা মাকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে আনন্দ পাবে শিশুরা। অন্যের সমালোচনা নয়, কারো দোষ ক্ষমা করে দেওয়া, একত্রে কাজ করার অভ্যাস এবং যথাসময়ে নিজের পড়াশোনা তৈরি করবে। ভালো মানুষদের উদাহরণ সামনে থাকবে। মহানবী (সা) ও সাহাবায়ে কেরাম সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পবিত্র কুরআন পড়ার অভ্যাস এর পাশাপাশি অর্থ বুঝার দিকে শিশুদের মনোযোগ দেয়া দরকার। অধিকাংশ মুসলিম পরিবারের শিশুরা কুরআন শিক্ষার প্রতি একেবারেই উদাসীন। অভিভাবকের আগ্রহে বড়জোর কুরআন খতম করে কিন্তু অর্থ না জানায় কুরআনের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় তারা। এতে বয়সন্ধিকালে অনেকেই মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িত হয়ে যায়। আর যারা স্বাভাবিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে তাদের জন্য অবৈধ পথের স্বর্গরাজ্য খুলে যায়। মায়ের শিক্ষা সচেতনতা ও শিশুকে নিকট সাহচর্য দান এখানে গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রী হিসেবে নারী স্বামীর সম্পদের অংশীদার। সে সম্পদ বৈধ কি অবৈধ তা দেখা অবশ্যই স্ত্রীর অধিকার রয়েছে এবং এক্ষেত্রে অনেক নারী অবুঝ পশুর মতই বোধশক্তিহীন। খাওয়া-পরা, বাড়ি-গাড়ি, গয়না পেলেই সন্তুষ্ট। কোন পথে আসছে টাকা তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলে -

“এরা হলো পশুর মত বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট।" সূরা আরাফ: ১৭৯

আখিরাতে জবাবদিহীতার অনুভূতি থাকলে এ ধরনের জীবনযাপন সম্ভব নয়। আর নেক সন্তান এসব মায়েরা কিভাবে উপহার দেবেন? আমাদের মনে রাখতে হবে দুনিয়ার সহায়-সম্পদ, সন্তান, আর্থিক সংগতি কোনটাই আখেরাতে সহায়ক হবে না। পবিত্র কুরআনের ভাষায়

“জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য মানুষ তার পিতা ভাই সন্তানও আপনজন এমন কি সারা পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময় হিসেব দিতে চাইবে কিন্তু তা গৃহীত হবে না।"

চারিত্রিক সংশোধন

বাহ্যিক বেশ-ভূষার আড়ালে চরিত্রহীনতা একটি প্রকট আকার ধারণ করেছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় মেয়েরা কখনও বাধ্য হয়ে কখনও লোভে পড়ে নালয়ে বিপথে। গত কয়েক বছরে ইডেনের ঘটনাবলী তার সাক্ষী। এসব মেয়েরা সঙ্গল না হবে তখন অপরাধপ্রবণ একটি সমাজ উপহার দেবে শুধু। আগাছা পরগাছা মুক্ত করতে হলে সংশোধনের কার্যক্রম জরুরি। ছাত্রী অঙ্গনে সংস্কারকাজে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। কুরআন শিক্ষার প্রসার মহিলা অঙ্গনে পরিবর্তন আনতে পারে।

সমাজে নারী

নারীর কর্মক্ষেত্র গৃহ হলেও তার প্রভাব সর্বত্র। এই প্রভাব বলয়ে আবদ্ধ পুরুপকূল তাই নারীদের সচেতনতা সর্বাগ্রে জরুরী। নারীর নিম্নোক্ত ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ:

এক. হারাম উপার্জনে পুরুষকে নিরুৎসাহীত করা

তার আগে হারাম-হালালের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নিজেকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তুলতে হবে। যেকোনো সদুপায় রোজগারে সহযোগিতা করতে হবে এ প্রসঙ্গে হাদিস উল্লেখযোগ্য -

"নিজ হাতে অর্জিত হালাল রোজগার এর চেয়ে উত্তম কিছু নেই।"

দুই. বৃদ্ধাশ্রমের যাওয়া রোধ করা

অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীদের প্ররোচনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিরক্তি, অসন্তোষ ইত্যাদি কারণে পুরুষরা তাদের মুরব্বীদের ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে যার বাড়িঘর নেই লেদা শোনার কেউ নেই তাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় অথবা স্বাবলম্বনহীনকে রাস্তায় নামতে হয়। এটা ভাবা দরকার যে, যাকে নিয়ে আমি এখন সুখি জীবন যাপন করছি- তার বাবা-মা না থাকলে আমি তাকে পেতাম না। সুতরাং তার বাবা-মা আমার কাছে ততটুকুই প্রাধান্য পাবেন, যতটুকু আমার স্বামী। আজ যে গৃহিণী প্রদল নপুটে কাল সে অসহায় নারী। নিজেদের ভবিষ্যৎ ও আখেরাতে সফলতার চিন্তা কর মুরুব্বীদের প্রতি যত্নশীল হওয়া দরকার।

তিন, আত্মীয়তার হক আদায় করা

নিজের আত্মীয় স্বামী আত্মীয়-স্বজনের মেহমানদারীর দায়িত্ব স্ত্রীর উপরেই থাকে এখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এর সাথে প্রত্যেক আত্মীয় কে সেবা-যত্ন করলে সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। যেকোন বিপদে অন্যেরা এগিয়ে আসে মহানবী (স) বিবি খাদিজা (রা:) ইন্তেকালের পরও তার বান্ধবীদের কাছে উপহার উপঢৌকন পাঠাতেন।

চার. প্রতিবেশীদের হক আদায়

আত্মীয়ের চেয়ে যিনি কাছের এবং তাৎক্ষণিক উপকারী তিনি প্রতিবেশী। মহানবী (সা:) প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। প্রতিবেশী অমুসলিম হলেও তার প্রতি দায়িত্ব রয়েছে।

পাঁচ. দ্বীনি সম্পর্কের হক আদায়

ঈমান বা বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্ক জড়িত। আদর্শ লক্ষ এক হলে সম্পর্ক হবে নিবিড়। মহানবী (সা:) বলেছেন, "মুসলমান মুসলমানের ভাই। না সে কোন মুসলমানকে কষ্ট দেবে, না সে তার উপর কোন জুলুম করবে। বিপদে তাকে সাহায্য করবে। সালাম বিনিময় করবে এবং জানাজায় অংশ নেবে।"

ছয়. সকল কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ

পারস্পারিক সহযোগিতা নিয়েই সমাজ। অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়া, বিবিধ প্রয়োজনে সহযোগিতা করা, ছেলে মেয়ের বিয়ে শাদী ও চাকরি-বাকরিতে একক চেষ্টার চেয়ে সামাজিক প্রচেষ্টা অধিক জরুরি। কল্যাণমূলক কাজের সীমা অত্যন্ত বিস্তৃত সকল প্রকার মানবিক সেবা এর অন্তর্ভুক্ত। বয়েজ স্কাউট ও গার্লস গাইড এই সেবার কাজ করছে কিন্তু স্বল্প সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এতে অংশ নিচ্ছে। মায়েদের উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি সন্তানদের সামাজিকিকরণে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীদের বৃহৎ অংশকে একাজে সংযুক্ত করতে হবে। মহানবী (সা:) হিলফুল ফুজুল-এ যোগ দিয়ে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন।

সাত, অন্যায় কাজে বাধা দান

প্রশ্ন আসতে পারে নারীরা তো দুর্বল। এ কাজে বাধা দিবে কি করে? বাধা দেয়ার জন্য শক্তিশালী হওয়া জরুরী নয়। নৈতিক সাহস, মনোবল ও কৌশল থাকতে হয়। পূর্বেই বলেছি স্বল্প সংখ্যক লোক অপরাধে জড়িত থাকে। বাকিদের মধ্যে কেউ সাহায্যকারী, কেউ নীরব দর্শক। এই নীরব দর্শক যারা তারাই ভুক্তভোগী। এরা নিজেকে বাঁচানোর জন্য নীরব থাকে, কিন্তু বাঁচতে পারে না। সাহসী নারীদের কাজ হবে এই তিন শ্রেণীতেই। বাধা দেয়া বা বলার সৎ সাহস নিয়ে এগিয়ে আসলে কিছু কাজ হবে। কারণ মানুষের মধ্যে নাফসে লাওয়ামা তিরস্কারকারী মন রয়েছে। এমনিতেই অন্যায়কারী নৈতিকভাবে দুর্বল থাকে। সঠিক যুক্তি সহকারে উপযুক্ত সময়ে পদক্ষেপ নিলে তার বিবেক ফিরে আসতে পারে।

দ্বিতীয়ত, যারা সাহায্যকারী তাদেরকে উত্তম নসীহত ও আখেরাতের ভয় জাগ্রত করে সাবধান করা। আল্লাহর সাহায্য পেলে তারা এ পথ থেকে সরে আসবে।

তৃতীয়ত, সাধারণ ভুক্তভোগী জনতা।

ভীরু তাই তাদের প্রধান দুর্বলতা। উপযুক্ত প্রণোদনায় তারা সাহায্যে সাহসী হয়ে

উঠবে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার অনুশীলনে উদ্বুদ্ধ করলে সমাজের সাহসী শ্রেণী বাড়বে।

"তোমরা এমন এক জাতি যাদেরকে উপস্থাপন করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য। যারা ন্যায়ের আদেশ করবে, অন্যায়ের প্রতিরোধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখবে।"

[আল-ইমরান ১১০]

সমাজ জীবন পরিগঠনের নারীর ভূমিকা একক নয় কিন্তু অসামান্য। পুরুষ যদি সমাজে দেহ হয়, নারী তার আত্মা। আত্মার মৃত্যুতে দেহের বিনাশ এটা সমাজের সার্বিক বিপর্যয় ডেকে আনে। নারীর সক্রিয়, বলিষ্ঠ ও ন্যায় সঙ্গত ভূমিকা দিতে পারে উন্নত সমাজ। বর্তমানের ধ্বংসোন্মুখ সমাজে সচেতন নারীরা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহচর্য দিয়ে একে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। উন্নত সমাজ, উত্তম জাতি গঠনে নারীর অবদান হবে অতুলনীয়